বিজ্ঞাপন

একজন সেঁজুতির বিজ্ঞানী হয়ে ওঠা

May 24, 2020 | 11:00 am

রাজনীন ফারজানা

বলা হয় ভোরের সূর্য দেখেই নাকি দিনের আন্দাজ পাওয়া যায়। তৃতীয় শ্রেণিতে স্কুলের বিজ্ঞানমেলায় রক্তের গ্রুপ নির্ণয়ের প্রোজেক্ট বানিয়ে হইচই ফেলে দিয়েছিল মেয়েটি। বাবা-মায়ের সহযোগিতায় বানানো সেই প্রোজেক্ট ব্যবহার করে একজন শিক্ষকের রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করেছিল সে। রক্ত সংগ্রহ করার সেই ছবি আজও নিজের টেবিলে রেখে দিয়েছেন আজকের দেশব্যাপী সাড়া ফেলে দেওয়া তরুণ বিজ্ঞানী ড. সেঁজুতি সাহা।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশে কোভিড-১৯ ভাইরাসের জিনোম সিকুয়েন্স আবিষ্কার করা গবেষকদলের নেতৃত্বে ছিলেন ড. সেঁজুতি সাহা। বাবা বিখ্যাত অণুজীববিজ্ঞানী ও গবেষক ড. সমীর কুমার সাহা ও মা আরেক অণুজীবিজ্ঞানী ও গবেষক ড. সেতারুন্নাহার। সেঁজুতি বর্তমানে কর্মরত আছেন বাবার প্রতিষ্ঠিত অলাভজনক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশন (সিএইচআরএফ)। সম্প্রতি এই বিজ্ঞানী বাবা-মেয়ের গল্প সবার মুখে মুখে। কিন্তু আমাদের আজকের গল্পটা শুধুই সেঁজুতির। বাংলাদেশের মত একটি পুরুষতান্ত্রিক দেশে যেখানে অসংখ্য মেয়েকে বাল্য বিয়ে দেওয়া হয়। মেধাবী মেয়েটির বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী ব্যয় হয় সন্তানকে লেখাপড়া শেখাতে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা ফার্মাসিস্ট মেয়েটিকেও বিয়ে করে হতে হয় কারও স্ত্রী, কারও মা। সেই পরিবেশ থেকে কীভাবে একজন বিজ্ঞানী হলেন সেঁজুতি।  তাও একেবারে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিজের ও দেশের নাম উজ্জ্বল করা বিজ্ঞানী। যাকে নিয়ে লেখা প্রকাশিত হয় বিল গেটস জার্নালে। চলুন জেনে নেই একজন সেঁজুতির ড. সেঁজুতি হয়ে ওঠার গল্পটা কেমন ছিল।

অণুজীববিজ্ঞানী বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান সেঁজুতির জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকায়। বাবা-মা দুজনেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। পরে তারা ভারত থেকে অণুজীববিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। সেঁজুতির মা ড. সেতারুন্নাহার। প্রথমে কর্মরত ছিলেন আইসিসিডিডিআরবিতে পরে ভ্যাকসিন ইন্সটিটিউট অব পাবলিক হেলথে জয়েন করেন। আর তার বাবা প্রথম থেকেই ঢাকা শিশু হাসপাতালের অণুজীব বিভাগে কর্মরত আছেন। বাংলাদেশের শিশু মৃত্যুহার কমাতে সেখানেই প্রতিষ্ঠিত করেন গবেষণাগার। উল্লেখ্য সেঁজুতির একমাত্র ছোটভাইও একজন অণুজীববিজ্ঞানী।

অণুজীববিজ্ঞানী পরিবার

কেমন ছিল সেঁজুতির শৈশব?

বিজ্ঞাপন

‘বাবা-মা দুজনেই কর্মজীবি হলেও আমার ছেলেবেলাটা অতটা স্বাচ্ছল্যের ছিল না। তারা দুজনেই মাত্র চাকরিতে ঢুকেছেন। ছোট একটা বাসায় থাকতাম। একটা লোকাল স্কুলে ভর্তি করে দেন আমাকে। কিন্তু বাবা-মা আমাকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াতে চাইতেন। কিছুদিনের মধ্যে তারা চাকরির পাশাপাশি বিকেলে ঢাকার নামকরা কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে প্র্যাকটিস শুরু করেন। ফলে আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা কিছুটা ভালো হলে আমাকে বিআইটিতে ক্লাস থ্রিতে ভর্তি করানো হয়।’

এরপরই তার জীবনের মোড় ঘুরে যায়, ব্যাপারটা কিন্তু তা ছিল না। ঠিক উপন্যাসের মতই তার জীবনের গল্পে নানা টার্ন এন্ড টুইস্ট। তবে অণুজীববিজ্ঞানে আগ্রহের সূচনা তখন থেকেই। গবেষক বাবা-মায়ের বাসায় ফিরতে দেরী হয়ে যায় প্রায়ই। তাই দেখা যেত স্কুল ছুটির পর ছোট্ট সেঁজুতিকে প্রায়ই বাবা অথবা মায়ের ল্যাবে সময় কাটাতে হত। সেঁজুতির বাবা তাকে তখনই মাইক্রোস্কোপে ব্যাকটেরিয়া পরীক্ষা করতে দিতেন। ল্যাবের এই পরিবেশটা ভেতরে ভেতরে প্রভাব ফেলে ছোট্ট সেঁজুতির। বাবার কাছ থেকে শেখেন বিজ্ঞান কীভাবে পাবলিক হেলথের সঙ্গে জুড়ে মানুষের কাজে লাগানো যায়। আর তার মা একজন নারী হয়েও সেসময় ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করে ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা করছিলেন- আদর্শ ব্যক্তিত্ব সবসময় সেঁজুতির ঘরেই ছিল। বাবা শেখাতেন হাতের কাছে যা আছে ততটুকুই কাজে লাগিয়ে গবেষণা কর আর মা শেখাতেন জ্ঞান বিজ্ঞানকে সবসময় ন্যায়ের পথে ব্যবহার করতে। সেবছরই বাবা-মায়ের সহযোগিতায় স্কুলের বিজ্ঞানমেলায় রক্তের গ্রুপ পরীক্ষার প্রোজেক্ট বানিয়ে প্রথম পুরষ্কার জেতেন। এরপর থেকে প্রতিবছরই বিজ্ঞানমেলায় কোন না কোন পুরষ্কার বাঁধা ছিল সেঁজুতির নামে।

তিনি কি ট্র্যাডিশনাল ভালো ছাত্র যে সারাদিন বইয়ে মুখ গুঁজে থাকে? না। ইংরেজি মাধ্যমে পড়লেও প্রচুর বাংলা বই পড়তেন। নিয়মিত আবৃত্তি করতেন। পেতেন পুরষ্কার। লেখাপড়া আর আবৃত্তির পাশাপাশি আর কি করতেন জানতে চাইলে হাসতে হাসতে সেঁজুতি মজার অভিজ্ঞতা শোনান। মেয়ের ভালো লাগে নাচ কিন্তু বাবা-মায়ের শখ মেয়ে গান শিখবে। ঢাকার এক নামি নাচ-গানের স্কুলে গানের ক্লাসে ভর্তি করে দেন মেয়েকে। কিন্তু সেঁজুতির ভাষায়, ‘আমার তাল লয় এত খারাপ ছিল যে সেই স্কুল থেকে আমাকে বের করে দেয়!’ গানের স্কুলে সুবিধা না করতে পেরে নিজের আগ্রহে সেই স্কুলেরই অন্য ফ্লোরে নাচের ক্লাসে ভর্তি হন। কিন্তু নাচেও নাকি তার তাল আর লয় জ্ঞান বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। সেখান থেকেও বহিস্কৃত হন বলতে বলতে হাসি থামে না সেঁজুতির। এরপর তার মা বাড়িতেই একজন গানের শিক্ষক রেখে দেন। এই শিক্ষকের অবদান কখনো ভুলবেন না আজকের এই তরুণ বিজ্ঞানী। গানের গৃহশিক্ষকও অল্প দিনে ধরে ফেলেন এই মেয়েকে দিয়ে গান হবে না। তবে তিনি প্রচুর বই পড়তেন এবং সেঁজুতির মধ্যেও বই পড়ার আগ্রহ জাগিয়ে তোলেন। এছাড়া সেঁজুতির বাবা ড. সমীর সাহার পরিবারের সবাই প্রচুর বই পড়ত সেটিও নিজের রক্তে চলে এসেছে বলে মনে করেন তিনি।

বিজ্ঞাপন

এভাবেই ২০০৩ সালে ও লেভেল দেন সেঁজুতি। ৮ টি বিষয়ের প্রতিটিতে এ পান। এ লেভেলের শুরুতেই পড়াশোনা নিয়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে মতবিরোধের সূচনা। অংক এবং অর্থনীতিতে ভালো ছিলেন তাই বাবা-মা চাচ্ছিলেন মেয়ে যেন অর্থনীতিতে উচ্চ শিক্ষা নেয়। এর পেছনে কারণটা অবশ্য পুরোটাই বাস্তবভিত্তিক। দুজনেই কর্মজীবি হলেও তাদের ইকোনমিক হার্ডশিপ কিছুটা ছিলই। এই কারণেই তারা চাইতেন মেয়ে বিজ্ঞানে না পড়ে অর্থনীতিতে পড়ুক। স্কুল কর্তৃপক্ষকেও জানিয়ে দেন যে সেঁজুতি বিজ্ঞান নিচ্ছে না। কিন্তু মেয়ের জিদ সে বিজ্ঞানেই পড়বে। এবং বাবা-মায়ের সঙ্গে রীতিমত যুদ্ধ করে বিজ্ঞানে ভর্তি হন। সেঁজুতি বলেন, ‘অনেকে ভাবেন বাবা-মেয়ের ইচ্ছাতেই বিজ্ঞানী হওয়া কিন্তু আসলে তা নয়।’

এরপর টুয়েলভে পড়ার সময় ঠিক করেন দেশের বাইরে পড়তে যাবেন। এদিকে তার পরিবারের কেউ কখনো এত অল্পবয়সে বাইরে পড়তে যায়নি। বাবা-মা ইন্ডিয়া থেকে পড়ে আসলেও আমেরিকা বা কানাডা কখনো যাননি। তাই বিদেশে পড়ার কথা বলতেই প্রথম বাঁধা আসে পরিবার থেকে। সেই দুই হাজার চার সালেও কোন মেয়ে একা একা বাইরে পড়তে যাচ্ছে, এটি অনেক বাঙালি পরিবারেই ভাবতে পারতো না। সেঁজুতি তাও বাবা-মাকে বুঝিয়ে ফেললেও বাঁধা আসে সম্পূর্ণ নতুন দিক থেকে। বাবা-মা নিমরাজি হতে না হতেই আত্মীয়-পড়শিদের ফোন আসতে থাকে বাসায়- ‘মেয়েকে একা বিদেশে পাঠাবেন? আর কিন্তু ফিরে আসবে না। এই গেল হাতছাড়া হয়ে।’

এমন টানাপোড়েনের মধ্যেই এ লেভেল দেন সেঁজুতি। এদিকে তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুর পরিবারের অনেকেই কানাডা থাকে তাই সে কানাডা যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। সেঁজুতি ঠিক করেন প্রাণের বান্ধবীর সঙ্গে তিনিও কানাডা যাবেন যেহেতু আমেরিকায় কাউকে চেনেন না। বন্ধুর সঙ্গে মিলে বাবা-মাকে না জানিয়েই ৪ টি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করেন ও সবগুলোতেই স্কলারশিপসহ এডমিশন পেয়ে যান। এই আবেদনগুলো করেন বাবা (অথবা বাবার বন্ধুর- মনে করতে পারছিলেন না) ক্রেডিট কার্ডের ইনফরমেশন চুরি করে। এই নিয়ে তুমুল হইচই। এর মধ্যে টরেন্টো ইউনিভার্সিটির স্কলারশিপের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি হওয়ায় সেটিতে ভর্তি হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বন্ধুও একই বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পান। এতো ভালো বিশ্যবিদ্যালয়ে স্কলারশিপ পাওয়ায় মানুষের কথা পাত্তা না দিয়েই তারা বাবা-মা রাজী হন মেয়েকে পাঠাতে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরে ২০০৫ এর এপ্রিলের শেষে এ লেভেলের রেজাল্ট বের হলে দেখা গেল তিনি চার বিষয়ের সবগুলোতে এ পেয়েছেন। তারপর ভিসা নিয়ে সেপ্টেম্বরের ২ তারিখ উড়াল দেন টরেন্টো। বাবা যান মেয়েকে রেখে আসতে। তিন দিন থেকে মেয়েকে নিরাপদে হোস্টেলে উঠিয়ে দিয়ে তবে ফেরেন।

ড. সেঁজুতি সাহা ও তার বাবা ড. সমীর কুমার সাহা

মূলত সেই থেকেই জীবনের মোড় ঘুরে যায় প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর সেঁজুতির। সেসব দিনের কথা মনে করলে কেমন লাগে তার। এইযে একলা একটা মেয়ে বিদেশে পড়তে যাবে এটা নিয়ে সোশ্যাল ট্যাবু ভাঙাটা কী পরিকল্পিত ছিল? সেঁজুতি বলে, আমার কাছে বিষয়টা ছিল, ‘আমি এটা করতে চাই, তো চাই। কে কি বলছে অত ভাবিনি কখনো। যা চেয়েছি তা করেই ছেড়েছি।’

বিজ্ঞাপন

টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়ো কেমিস্ট্রিতে আন্ডারগ্রাজুয়েটে ভর্তি হন। একবছর পর দ্বিতীয় বর্ষে উঠে একটা মলিকিউলার জেনেটিকস রিসার্চ ল্যাবে পার্ট টাইম চাকরি নেন। শতভাগ স্কলারশিপ না পাওয়ায় বাবা-মাকে তখনও দেশ থেকে কিছু টাকা পাঠাতে হত। তাতে মৌলিক প্রয়োজন মিটলেও সেঁজুতি চাইতেন নিজে কিছু একটা করতে। এদিকে বাবা-মা মেয়েকে কিছুতেই অড জব করতে দেবেন না। রিসার্চ ল্যাবে চাকরি পেয়ে সেই বাঁধা দূর হয়। পরে সেখানকার কাজেই মন লেগে যায় সেঁজুতির। এরপর পাশ করে আমেরিকা যেয়ে পিএইচডি করার ইচ্ছা থাকলেও কানাডাতেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়েই ২০০৯ সালে মলিকিউলার জেনেটিকসে পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তি হন।

এই ল্যাবে কাজ করতেই করতেই খুঁজে পান নতুন প্যাশন। জিমে পোস্ট ডক্টরালের এক ছাত্রীর কাছ থেকে শোনেন অদ্ভুত এক খবর। এদেশে নাকি রেস হয় আর সেই রেসে ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে দৌড়ানো যায়। শুনে অবাক হন সেঁজুতি। এর আগে টিভিতে রেসের মাঠে মেয়ে অ্যাথলেটদের দৌড়াতে দেখেছেন। কিন্তু যে কেউ ইচ্ছা হলেই রেসে অংশ নিতে পারেন এটি ছিল তার কাছে বিস্ময়। বিশেষ করে বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে বড় হওয়া একজন মেয়ে এমনটা ভাবতেই পারেননি। এরপর দৌড়ের মধ্যেই ভালোবাসা খুঁজে পান তিনি। সপ্তাহে পাঁচদিন দৌড়াতেন। ২০১০ থেকে ১১ সালের মধ্যে অন্তত পক্ষে সাত থেকে আটটি রেসে অংশ নেন। মজার ব্যাপার হল, এসব রেসে অংশ নিতে টিকেট কাটতে হত কারণ এইসব রেস আয়োজন হত কোন না কোন সামাজিক কাজের অর্থ সাহায্যের জন্য। যা আয় করতেন তার একটা বড় অংশ ব্যয় করতেন চ্যারিটি রেসের রেজিস্ট্রেশনে। রেসে অংশ নেওয়ার অভিজ্ঞতাকে তিনি ‘লাইফ চেঞ্জিং এক্সপেরিয়েন্স’ হিসেবে দেখছেন। ১০ থেকে ২১ কিলোমিটার পর্যন্ত দৌড়েছেন বিভিন্ন রেসে যা তার আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ।

এরপর ২০১১ সালে সেঁজুতির মা ড. সেতারুন্নাহার প্রথমবারের মত কানাডা যান মেয়েকে দেখতে। সেবারই কঠিন রোগ ধরা পড়ে তার। ২০১৩ সাল পর্যন্ত চলে চিকিৎসা। সেসময় সেঁজুতির মা চাকরি বাকরি বাদ দিয়ে মেয়ের সঙ্গে কানাডাতেই ছিলেন পুরোটা সময়। অসুস্থতার জন্য পিছিয়ে যায় সেঁজুতির পিএইচডি গবষণা যার বিষয় ছিল অ্যান্টিবায়োটিক রেজিসট্যান্স। দেশের মানুষের জন্য কিছু করার আগ্রহ থেকেই গবেষণার বিষয় হিসেবে বেছে নেন অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্স। পরবর্তীতে সুস্থ হয়ে পুরোদমে গবেষণায় মন দেন তিনি।

তখন বিল এন্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন বাংলাদেশে শিশু মৃত্যহার কমাতে কাজ করছিলো। সেখানে আবেদন করেন ও ২১০৬ তে গবেষণার কাজে দেশে চলে আসেন ও বাবার প্রতিষ্ঠান সিএইচআরএফে যোগ দেন।

দেশে এসে সেঁজুতি অবাক হয়ে লক্ষ্য করেন এক দশকেও বদলায়নি সেইসব মানসিকতা যারা তার বিদেশ যাওয়া নিয়ে বক্রোক্তি করেছিলো। তখন তাদের আলোচনার বিষয় ছিল একা মেয়ের বিদেশে পড়তে যাওয়া। আর এবারের বিষয় মেয়ের ফিরে আসা নিয়ে। কারণ, এর মধ্যেই বিয়ে করেছেন সেঁজুতি। তিনি কী নিয়ে গবেষণা করছেন বা কেরিয়ার বিষয়ক কথা না বলে অধিকাংশেরই প্রশ্ন ছিলো, ‘তোমার স্বামী কী খায়?’ অর্থাৎ একা একজন পুরুষ মানুষ স্ত্রীকে ছেড়ে কীভাবে বিদেশে সারভাইভ করছেন!

সেঁজুতির স্বামীও একজন গবেষক। বর্তমানে তিনি যুক্তরাজ্যে কর্মরত আছেন। দুজনেই কেরিয়ারের ব্যাপারে ভীষণ সিরিয়াস। কে কী করছেন জীবনে খুব ভালো করে জানেন তারা। তাই মানুষের এসব কথা খুব হাস্যকর লাগে সেঁজুতির কাছে।

বাবা-মা, ভাই ও স্বামীর সঙ্গে সেঁজুতি সাহা

যাই হোক, সেঁজুতি কখনোই লোকের কথা পাত্তা দেননি। ঢাকায় ফিরে মনোযোগ দেন গবেষণায়। কাজ শুরু করেন জিনোম সিকুয়েন্স নিয়ে। আমাদের দেশে অনেকসময় অনেক শিশু জ্বর বা খিঁচুনিতে মারা যায়। কিন্তু এভাবে এমনি এমনি তো কেউ মারা যায় না। এর পেছনে নিশ্চয় কোন ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস জড়িত, ভাবতেন তিনি। এসব অসুখের রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা চালিয়ে যান তাই। সেঁজুতির গবেষণার মূল বৈশিষ্ট্য হল পুরো কাজটাই তিনি দেশে সম্পাদন করার চেষ্টা করেন। কারণ, বাংলাদেশে নমুনা সংগ্রহের পর জিনোম সিকুয়েন্সের জন্য সাধারণত বিদেশে পাঠাতে হত।

এরপর উচ্চতর গবেষণার জন্য চ্যান জাকারবার্গ বায়োহাবের বৃত্তি নিয়ে আমেরিকা যান সেঁজুতি। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, সানফ্রান্সিসকোর সঙ্গে কোলাবোরেশন হয় তাদের প্রতিষ্ঠানের। সেবছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে বিল এন্ড মেলিন্ডা ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সেঁজুতির নামে প্রথমবারের মত একটি জিনোম সিকুয়েন্স মেশিন আসে চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনে। এর আগে যত মেশিন আসত তা তার বাবা ড. সমীর সাহার নামে আসতো। তাই নিজের নামে এই মেশিনও আসাটা সেঁজুতির জন্য বেশ গর্বের। এই মেশিনটা আসার পর নিজের গবেষক দল গড়ে তোলেন সেঁজুতি সাহা। কোর টিমে ছয়জন ছাড়াও আরও অনেকেই কাজ করছেন তার সঙ্গে।

গবেষণা তো চলছিলই। স্বপ্ন পূরণে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ সেঁজুতি এগিয়ে চলছিলেন দৃঢ় পায়ে। এর মধ্যেই কাজের অসাধারণ এক স্বীকৃতি আসে তার জীবনে। ২০১৯ এর সেপ্টেম্বরে উন্নয়নশিল দেশের গবেষক প্রতিনিধি হিসেবে বিল গেটসের সঙ্গে জাতিসংঘের অধিবেশনে বক্তব্য রাখেন তিনি। প্রতিবছরই জাতিসংঘের অধিবেশনে বিল গেটসের একটি সেশন থাকে যেখানে তিনি নিজে বক্তব্য দেন এবং উন্নয়নশীল দেশ থেকে দুজন করে বিজ্ঞানী নিয়ে যান। গতবছর বাংলদেশকে প্রতিনিধিত্ব করেন সেঁজুতি সাহা আর ব্রাজিল থেকে আসে আরেক মেয়ে বিজ্ঞানী। বক্তব্যের বিষয় ছিল, টেন/নাইন্টি গ্যাপ।

এর অর্থ হল উন্নয়নশীল দেশে শিশু মৃত্যুহার উন্নত বিশ্বের তুলনায় অনেক বেশি হলেও গবেষণা হয় মূলত উন্নত দেশগুলোতে। যেখানে উন্নয়নশীল দেশে শিশু মৃত্যুহার নব্বই শতাংশ, সেখানে এসব দেশের কাছে রিসোর্স আছে মাত্র দশ শতাংশ। একেই বলা হয় ‘টেন/নাইনটি গ্যাপ।’ সারা বিশ্বের সামনে বাংলাদেশের শিশুদের অবস্থা তুলে ধরেন তরুণ এই বিজ্ঞানী।

ড. সেঁজুতির মুকুটে সর্বশেষ সাফল্যের পালক যুক্ত হয়েছে সম্প্রতিই। বাংলাদেশে চলতি বছরের মার্চের ৮ তারিখ প্রথম করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী ধরা পড়ে এবং এই রোগে প্রথম কেউ মারা যান ১৮ মার্চ। তখনই কোভিড-১৯ এর জিনোম সিকুয়েন্সের কাজ শুরু করেন সেঁজুতি ও তার গবেষক দল। কিন্তু এর মধ্যেই ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ইংল্যান্ডে যেতে হয় তাকে। ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইন শেষে ২৯ মার্চ স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে দেশে এসে গবেষণার কাজ শেষ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেদিনই ইংল্যান্ডে লক ডাউন ঘোষণা হয়। রেডি হয়ে বাক্স প্যাটরা নিয়ে বেরও হয়েছিলেন কিন্তু বিমানবন্দর বন্ধ করে দেওয়ায় আর দেশে ফিরতে পারেননি।

কিন্তু এই বাঁধায় দমে যাওয়ার মেয়ে ড. সেঁজুতি নন। তিনি বিদেশে বসেই ক্যামেরার সাহায্যে ল্যাবের কার্যক্রম চালিয়ে যান। তার টিমও সর্বাত্মক সহযোগিতা করে। দিন নাই, রাত নাই ল্যাপটপের ক্যামেরায় দেখে দেখে দলকে গবেষণা কাজের নির্দেশনা দিয়ে গেছেন তিনি। এভাবেই গত ১২ মে আট সদস্যের এই দল আবিষ্কার করেন বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের জিনোম সিকুয়েন্স যা এই জনগোষ্ঠির জন্য কার্যকরী ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতে ভূমিকা রাখবে। সেই উদ্দেশ্যে গবেষণার ফলাফল পাবলিক করে রাখা হয়েছে যাতে যে কেউ তথ্য নিয়ে ভ্যাকসিন আবিষ্কারের কাজ চালিয়ে যেতে পারেন।

ইতোমধ্যে বিখ্যাত বাবা ড. সমীর কুমার সাহার পাশাপাশি মেয়ের নাম উচ্চারিত হতে শুরু করেছে। ভবিষ্যৎ স্বপ্ন কী তার? বাবার মতোই মেয়েও শিশু মৃত্যুহার কমানো নিয়ে কাজ করেন। ভবিষ্যতেও শিশুদের নানারকম সংক্রামক রোগ নিয়ে কাজ করতে চান। খুঁজে দেখতে চান মেনিনজাইটিস কেন হয়। চেষ্টা করবেন এর ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতে। ছেলেবেলা থেকেই যে বাবা-মা শিখিয়েছেন বিজ্ঞানকে মানুষের কাজে লাগাতে হবে।

হাসিখুশি পরিবার করে যাচ্ছে বিজ্ঞানের সাধনা

বাংলাদেশে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি আগ্রহ কম কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আসলে সারা পৃথিবীতেই বিজ্ঞানের মূল্যায়ন কমেছে। বাংলাদেশেও তাই। হয়ত আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় কোন একটা ঘাতটি থেকে যাচ্ছে।’ তবে তার গবেষক দলে অনেক আগ্রহী ছেলেমেয়ে দেখতে পান। তাই তিনি আশা হারাতে চান না।

করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে বন্ধ আছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, থেমে আছে এইচএসসি পরীক্ষা। এই অবস্থায় হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে আমাদের শিক্ষার্থীরা। তাদের জন্য কী পরামর্শ থাকবে তরুণ এই বিজ্ঞানীর- ‘জীবনে এই সময়টা আর কখনো পাওয়া যাবে না। পড়াশোনা, কেরিয়ারের ব্যস্ততায় বই পড়া বা সৃজনশীলতা অনুশীলনের সময় মিলবে না। তাই আমি বলবো প্রচুর বই পড়ে ও শখের কাজ করে সময়টাকে কাজে লাগাতে। করোনাভাইরাস আমাদের শেখাচ্ছে কেউই নিরাপদ নয়। তাই নিরাপদ থাকতে কনফিডেন্স হারানো চলবে না কিছুতেই।’

সারাবাংলা/আরএফ/এসবিডিই

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন